কবিতা
প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে
(অনুবাদঃ আদৃত সোম)
প্রতিদিন ঘুম ভেঙ্গে
যে নরকে জেগে উঠি
তুমি আর আমি,
অসহ্য যন্ত্রণার যে কুম্ভীপাকে
আবর্তিত হই
একে অপরকে ঘিরে,
সেই নরকের অজস্র বীজাণু
বাতাসে ভেসে বেড়ায় যে প্রতিনিয়ত,
দেখেছ তুমি? বন্ধু আমার,
অপ্রতিরোধ্য প্রতারণার সেই ফাঁদ
পাতা আছে প্রতিটি পথের শেষে।
পরিত্রাণহীন সে রৌরবে
প্রত্যেকেই পৌঁছাবে, যাদের ঘুম এখনো গভীর,
আর যত পদ্মভূক স্বপ্নকাতর হৃদয়।
প্রতিদিন তুমি আমি
জেগে উঠি যে নরকে
ঘুম ভেঙ্গে;
প্রার্থনা করি, আর কারুর হৃদয়
যেন এভাবে অকারণ না হয় ক্ষয়।
আমার সে প্রার্থনা প্রতিনিয়ত প্রতিহত
নিয়মের চিরন্তন কঠিন দেয়ালে;
অনলের রূপমুগ্ধ হৃদয়ের পঙ্গপাল
অজস্র উড়ছে ওই দেখ!
নরকের ঘ্রাণ তাদের স্বচ্ছ ডানায়
কলংকের কাল রঙ হায় ক্ষমাহীন অবিরত এঁকে যায়।
জীবনানন্দ দাশ (অবসরের গান ,ধূসর পাণ্ডুলিপি ,1936)
অনামিকা মিত্র
প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা ছুটে চলেছি
অটোরিকশায়, সিএনজিচালিত গাড়িতে,
নিয়তির বেড়াজালে আটকে পড়া শাপিত দেবতার মত;
প্রতিদিন ভাড়া নিয়ে দর কষাকষি,
টিউশনির ফেরিওয়ালা হয়ে ঘোরাঘুরি,
জীবনের আশীর্বাদ আর অভিশাপ সব গেছি বুঝে।
বাস্তুতন্ত্র বুঝে নিয়ে হরিণের বেদনায়
অকৃত্রিম উদাসীনতা বুঝেছি আমি কবে!
তবু,
প্রেমের প্রমিত কবিতায় কামনার চিহ্ন
আশ্চর্য আশ্বাস দেয়;
মানুষের মৃত্যুকে নিরাময়যোগ্য অসুখ
মনে হয়;
সূর্যের নরম শরীরের ঘ্রাণ পাই
হেমন্তের আশ্চর্য সন্ধ্যায়;
গেঁয়ো ভাঁড় আর হেমন্তের ভাঁড়ারের গল্প
পড়ি ‘অবসরের গানে’।
অন্ধকারকে রহস্যময়ী মনে হয়;
নদীকে মনে হয় সময়-সময়ের স্রোত,
অন্ধকারে কলকল শব্দে নিয়ে আসে সে যে
কতকত বেহুলার, লহনার পরান-কথা আখ্যান;
হাঁসের পালক হাওয়ায় উড়ে যায়-
সরপুটিদের ঘ্রাণ; আকাশে নক্ষত্র জ্বলে উঠে ধীরে;
মনে হয় অবসর আছে জীবনের কাছে।
পৃথিবীর রোদ আর বৃষ্টিতে ভিজতে
তাই ভাল লাগে; নরম সূর্যের শরীরের ঘ্রাণ,
নিরাশাকরোজ্জ্বল জীবন, বাস্তুতন্ত্র,
সিএনজি আর মানুষের জীবনের মূল্য আছে,
তাই মনে হয়।
আমি রাবণ
আমি রাবণ,
স্বর্ণলংকা আমার পুড়ে গেছে।
রামের দেবত্ব আমার নাই,
স্মিতহাস্য সুদর্শন যুবক আমি না।
তবুও প্রেমিক আমি,
তোমাকে পাবনা জেনেও তোমার জন্য
অত সাধের সোনার লংকা
দিতে পারি বিসর্জন।
আমি রাবণ,
দেবতার ভণিতা আমার নাই,
সদা-সদালাপী ভদ্র যুবক আমি না।
আমি রাবণ
আমি অসুর
আমি দ্রাবিঢ়।
স্বর্ণলংকা আমার পুড়ে গেছে।
রাক্ষসের বেদনায়
কার হৃদয় প্লাবিত হয়?
কার চোখে জল আসে?
জানি, আমার জন্য শুধু ঘৃণার আয়োজন
তোমাদের চোখে-মুখে।
একটি আফ্রিকান কবিতা
মাসদুয়েক আগে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে ঘোরার সময় জানি না কেন একটা পুরোনো ম্যাগাজিনের কালেকশনের উপর চোখ পড়ল। খুব স্বস্তায় অনেকগুলো ম্যাগাজিন কিনে ফেললাম। বেশিরভাগই কবিতাবিষয়ক। ইংরেজী ভাষায়ও লিটলম্যাগসদৃশ সাহিত্যম্যাগাজিনের ছড়াছড়ি দেখে একটু অবাকই হলাম। হয়ত লিটলম্যাগ সবসময়ই কবিতা-চর্চার একটি অন্যতম মাধ্যম ছিল। যদিও আমি কোনদিন লিটলম্যাগের সাথে জড়িত ছিলাম না তবুও আমার এমনই মনে হয়। যাইহোক, ‘Poetry Northweast’ নামে একটি ম্যাগাজিনের আধো-ছেঁড়া একটি পাতায় নিচের কবিতাটি পেয়েছিলাম। সাথে অনুবাদকের ছোট্ট টীকা। অনুবাদক ও মূল কবি কারুরই কোন কাজের সাথে আমার পরিচয় নেই। ইন্টারনেটে অনেক ঘাটাঘাটি করেও তেমন লাভ হয় নি। কবিতাটিতে কেমন যেন চেনা একটা সুরের অনুরণন চোখে পড়ে। হয়ত পৃথিবীর সব কবি, সব আর্টিস্ট অবিছিন্ন কোন এক অদৃশ্য জগতে পরস্পর পরস্পরের প্রতিচ্ছবি। কবিতাটি অনুবাদ করতে ইচ্ছে হল। সামনে যখন খাতা নিয়ে বসলাম, পল ভ্যালেরির ‘La Feuille Blanche(The Blank Sheet)’এর কথা মনে পড়লঃ
“There is in all beauty a forbiddance to touch,
From which emanates I don’t know what of sacred
That stops the movement and puts the man
On the point of acting in fear of himself.”
যাইহোক, forbiddance ভেঙে touch যখন করলাম তখন যা দাঁড়াল তা নিম্নরূপঃ
“[আফ্রিকান কবি ‘আদিসা(১৯০৯-১৯৪৩)’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ডারবান থেকে অনেকদূরে অজ পাড়াগাঁয়। গোষ্ঠিগত দ্বন্দে খুব অল্প বয়সে নিহত হন তিনি। এক বিমূর্ত অপার্থিব জগতের রহস্যময়তার ইংগিত তাঁর কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। বাস্তবতাকে পরিহার করে অবাস্তব সম্ভাবনার সম্ভাব্যতায় বিশ্বাস করতেন। একটিমাত্র কবিতার বই ‘লিডজিস ভেন ঈনসামহেইড[নির্জনতার গান]’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। এখন প্রায় বিস্মৃত। তাই বইটিও খুব দূষ্প্রাপ্য। আমি জোহানসবার্গের এক ফুটপাত থেকে কিনেছিলাম। ইংরেজী অনুবাদে সাহায্য করেছেন জোহানসবার্গ ইউনিভার্সিটির তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ডক্টর ইয়ালাসাইদ। ]—টমাস আরভিং
রাত
আদিসা
রাত শেষ হয়ে যায়,
সকাল এসে দরোজায় কড়া নাড়ে
তোমাদের জগতে।
কিন্তু এখানে এই রহস্যঘেরা আঁধারে
রাত কখনো পালায় না;
সে আমার ঘুম এবং আমার স্বপ্ন
ধরে রাখে অনন্তকাল।
এখানে কুয়াশায় ডানা ঝাপটায়
প্যাঁচারা;
নিঃশব্দে ঝরে পড়ে
নঃক্ষত্র এবং পাতা;
আর,
রাত শুধু গভীর হতে থাকে;
গভীর থেকে গভীরতর;
অনন্ত গভীরতার দিকে এখানে রাতের গল্প
চলে অনন্তকাল;
জ্বলে অনন্তকাল
ক্রমশ ম্রিয়মান মোমবাতির আলো।
ইনসমনিয়া
(অনুবাদঃ আদৃত সোম)
তুমি উইলোর পাতায়
সাদা তুষারের মত
ফ্যাকাশে সাদা একটা মুখে
নীল পাণ্ডুর ঠোঁটে
যখন অদ্ভুত তির্যক হাসি হেসে
মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও
কিংবা যখন
শেষ বিকালের আলো
তোমার নিখুঁত চিবুক
বেয়ে গলে গলে পড়ে
ছায়াপথচুল
আর বরফসাদা ঘাড়ে
আলাস্কার তুষারিত
প্রান্তরে
অদ্ভুত চাঁদের
আলোর হাহাকারের মত
তখন
সবার অজানিতে
আমার দুচোখ হয়ে
হৃদয়ের ভিতরে
যা ঢুকে পড়ে
তা সৌন্দর্য নয়
কিংবা নয় প্রেম
কাম কারু-হেম
তখন
সবার অজানিতে
আমার হৃদয়ে
যা ঢুকে পড়ে
তার নাম মৃত্যু
সবকিছু শেষ হয়ে যায়
সব আলো সব অন্ধকার
শুন্যপাত্র পড়ে থাকে শুধু
আর নির্ঘুম রাত
আর নির্ঘুম রাত
আর নির্ঘুম রাত
路拍攝
第二李白
(অনুবাদঃ আদৃত সোম)
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথে আর কোন পদচিহ্ন নেই;
কোন ঝরা পাতা নেই।
কোন শোভাযাত্রা, শবযাত্রা কিংবা মিছিল
সেই পথে অগ্রসর হয় নি কোনদিন।
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি,
কেউ আমাকে কোনদিন বলেনি
সেই পথ ধরে হেঁটে যেতে,
কেউ কোনদিন করেনি বারণ।
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথে কোন কাঁটা নেই,
সেই পথে বিছানো নেই ফুলেল গালিচা।
কোন কবির কবিতায় নেই যে
সেই পথের হদিস,
কিংবা কোন মানচিত্রে।
তবুও তোমার যদি এত ভয়,
তবুও তোমার যদি মনে হয়,
আমার পথের সঙ্গী হয়ে
জীবন তোমার অহেতুক অপচয়;
তবে বন্ধু,
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথ যে তোমার নয়;
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথে তুমি আর এসো না;
অন্যপথে অযথা পথ দেখিও না।
আমাকে যে হেঁটে যেতে হবে আজীবন
এই পথেই,
এই পথেই
ফুরোবে অন্বেষণ আমার অনন্তকালের।
আমি যে পথে হেঁটে চলেছি
সেই পথ তবু আমার একার নয়;
অনাগত অসংখ্য শোভাযাত্রার দিন,
মিছিলের মুঠোবদ্ধ হাত দ্বিধাহী্ন,
মুখরিত হবে সেই পথে একদিন।